দল গোছাতে পারছেনা আ’লীগ-বিএনপি!
শাহাদত হোসেন বাচ্চু
একটি বিলবোর্ড। সারিবদ্ধভাবে সতেরজনের ছবি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি থেকে শুরু করে শেষাবধি স্থানীয় নেতা-পাতি নেতার ছবিও রয়েছে। রয়েছে দাগী আসামী, টেন্ডারবাজ-দখলবাজ, সন্ত্রাসীদের ছবিও, যারা হালে নেতা হিসেবে স্বীকৃত। সবশেষ বিলবোর্ডে যে ব্যক্তিটি ঈদের শুভেচ্ছা জানাচ্ছে, সেও একটি হত্যা মামলার চার্জশীটভুক্ত আসামী। এরকম বিলবোর্ডে ঢাকা পড়েছে বাংলাদেশ। বীতশ্রদ্ধ মানুষের মন্তব্য : প্রয়াত মহান নেতাকে এরা কোথায় নামাতে চায়? এদের উদ্দেশ্য করেই সৈয়দ আশরাফ মাত্র কিছুকাল আগে খাই-খাই ভাব বন্ধ করতে বলেছিলেন। পরিনতি সম্পর্কেও হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন। বলেছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালী জাতির নেতা। কিন্তু দাগী আসামী, মাদক ব্যবসায়ী, টেন্ডারবাজ, দখলবাজ আর সন্ত্রাসীদের সারিতে জাতীয় নেতৃবৃন্দের ছবি সম্বলিত বিলবোর্ড থাকে কি করে? সৈয়দ আশরাফ কি বলবেন?
মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের একটি বিলবোর্ডে ৩৭ জনের ছবি দেখে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, এরা কারা? তিনি বুঝতে না পারলেও এরা তো তারাই, যাদের প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যান্যরা বলে থাকেন বিএনপি-জামায়াত থেকে দলে অনুপ্রবেশকারী। এরাই সশস্ত্র ঘুরে বেড়ায়। প্রশাসন-পুলিশের অসৎ কর্মকর্তা ও অন্যান্যদের সাথে এদের গভীর সখ্য। কোন না কোন এমপি, মন্ত্রী বা জাঁদরেল নেতা এদের গডফাদার বা প্রতিপালক। ত্যাগী ও অঙ্গীকারাবদ্ধ নেতা-কর্মীদের উপেক্ষা করে এদের দলে পদ দেয়া হয়। ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা, সংসদ নির্বাচনে এরা দলীয় মনোনয়ন পেয়ে যায়। নির্বাচিত হয়, অল্পকাল পরেই আবির্ভূত হয় মাফিয়া প্রধান হিসেবে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি যখন ক্ষমতায় থেকেছে তখনই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। স্বাধীনতার প্রথম দশকে দালালী-চাটুকারিতা ও তৈল মর্দনের প্রতিযোগিতা চললেও তা বেশুমার বিলবোর্ডের আকার ধারন করেনি। ১৯৮২ সালে এরশাদ ক্ষমতায় আসার পরে পল্লীবন্ধু উপাধি পাওয়ার আগে-পিছে বিলবোর্ড কালচার ও প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল। আর এখন মহামারীর মত এই অপকালচার ঢেকে ফেলছে বাংলাদেশ। রাজধানীসহ বিভিন্ন শহরে বিলবোর্ড ভেঙ্গে ঘটছে দুর্ঘটনা, মরছে মানুষ! তাতে কি, বিলবোর্ডের মাধ্যমে চলছে স্ততি, চাটুকারিতা আর তৈল মর্দনের প্রতিযোগিতা।
বেশ কিছুকাল ধরে দেশের মানুষ শুনছে, দল পূনর্গঠন, দল গোছানো, দলকে শক্তিশালী করা, নেতৃত্ব পরিবর্তন ইত্যাদি। ক্ষমতাসীনরা অনেক সময় দলের মধ্যে শুদ্ধি অভিযানের কথাও বলে থাকেন। বহুকাল ধরে দেশের মানুষ জেনে আসছে এগুলি লোক দেখানো, কথার কথা এবং এক ধরনের আই ওয়াশ। ফলে এ নিয়ে তোড়-জোড় এবং হৈ-হাঙ্গামা চললেও কিছুদিনের মধ্যে দেখা যায়, থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতন্ত্রের সামান্যতম চর্চা না থাকায় সভাপতি বা চেয়ারপারসনের একক ক্ষমতা থাকায় কোন প্রশ্ন করা বা দ্বিমতের অবকাশ নেই। সেক্ষেত্রে পত্রপাঠ বিদায়। দলের গঠনতন্ত্রই এই ক্ষমতা ন্যস্ত করেছে নিশ্চয়ই তাদের ইচ্ছের প্রতিফলন হিসেবে। একটি বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র চালু থাকলেও সমস্ত ক্ষমতা যেমন কেন্দ্রীভুত প্রধানমন্ত্রীর হাতে, তেমনি দলের মধ্যেও সর্বময় কর্তৃত্ব দলীয় প্রধানের। এ অবস্থায় দল পূনর্গঠন, দল গোছানো বা শুদ্ধি অভিযান-যাই বলা হোক না কেন তা ব্যক্তির ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল।
ক্ষমতাসীন দল হিসেবে এরচেয়ে ভাল পরিস্থিতি আওয়ামী লীগের জন্য কখনই ছিল না, তবুও তাদের দল গোছানো হচ্ছে না। কোন্দল, গ্রুপিং, রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত। এমন কোন জেলা, উপজেলা, এমনকি ইউনিয়ন নেই যেখানে দলে কোন্দল নেই। অন্যদিকে বিএনপির জন্য পরিস্থিতি প্রতিকূল, পূনর্গঠনের কাজ ভেস্তে যেতে বসেছে। তাদেরও কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত দল ও সহযোগী সংগঠনও কোন্দল-গ্রুপিং রয়েছে- যা বেরিয়ে আসছে পূনর্গঠনে হাত দিতে না দিতেই।
এই মূহুর্তে আওয়ামী লীগের অন্তর্কোন্দলে অনেকগুলি জেলা- উপজেলায় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়নি। যেখানে সম্মেলন হয়েছে, সেখানে বিরোধের আগুন ছাইচাপা দিয়ে শীর্ষ নেতৃত্বের ইচ্ছেয় কমিটি হয়েছে। অথচ সিদ্ধান্ত রয়েছে, আগামী ডিসেম্বরে ঢাকায় দলের ত্রিবার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশন হবে। দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা নির্দেশও দিয়েছেন, একমাসের মধ্যে সম্মেলন ও পূর্নাঙ্গ কমিটি করে ফেলার জন্য। কিন্তু দলের মধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে, কোন্দল জর্জরিত বিভিন্ন জেলায় সম্মেলন হবে কি করে? তৃণমূলে অনেক এলাকায় বিরোধ এই পর্যায় পৌঁচেছে যে, নেতা-কর্মীরা এখন বিএনপিতে যোগদান করছে। দলের ৭৫ টি সাংগঠনিক জেলার অন্তত: ২৫টি জেলা ও মহানগর কমিটি স্থবির। এরমধ্যে চট্টগ্রাম অন্যতম।
জনগণের প্রতি অঙ্গীকার ও দায়বদ্ধতা না থাকায় প্রধান দলগুলির অভ্যন্তরে এটির অভাব প্রকট হয়ে উঠেছে। ব্যক্তির জন্য সব, ব্যক্তিমুখীনতা, উচ্চাকাঙ্খার প্রতিফলনই মূখ্য হয়ে উঠছে ৬৭ বছর বয়সী আওয়ামী লীগ ও ৩৭ বছর বয়সী দল বিএনপিতে। ক্ষমতাসীন দলের এখন বড় সুসময়। এই মাহেন্দ্রক্ষণেও দল গোছাতে পারছে না তারা। উল্টো মতবিরোধ ও কোন্দলে সাংগঠনিক কাঠামো বিপদগ্রস্ত হচ্ছে। ক্ষমতায় আছে বলে সংকট মাঝে-মধ্যে প্রকাশ্য হলেও দুর্বলতা ঢাকা দেওয়া যাচ্ছে। বছরের শেষার্ধে পৌরসভা নির্বাচন বা ২০১৬ সালের প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের কোন্দল রক্তাক্ত আকার নেয়ার আশংকা রয়েছে।
২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের টালমাটাল অবস্থার পর ক্ষমতাসীন দলের কোন্দল-সংঘর্ষ ছাড়া অভ্যন্তরীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোটামুটি নিথর-নিস্তরঙ্গ। অর্থনীতিও চালু রয়েছে। নিম্ন- মধ্য আয়ের দেশ হবার আমোদে-আহ্লাদে ক্ষমতাসীনরা একের পর গণবিরোধী সিদ্ধান্ত নিলেও বিরোধী দলবিহীন বাংলাদেশ এখন প্রায় প্রতিবাদহীন। মাঝে শিক্ষার ওপর ভ্যাট আরোপ নিয়ে ছাত্র-ছাত্রীরা রাস্তায় নামলে সরকার পিছু হটে ভ্যাট প্রত্যাহার করে নেয়। কিন্তু বিদ্যুৎ-গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি, অনেকগুলি কালো আইন ও গণবিরোধী সিদ্ধান্তের বিপক্ষে কোন আন্দোলন নেই যে সরকারের কানে পানি যাবে। এই সরকার যদি জনগণের অংশগ্রহনে নির্বাচিত হতো তাহলে গৃহীত গণবিরোধী সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে হয়তো কিছু বিবেচনা থাকতে পারত। কিন্তু অর্ধেকেরও বেশি আসনে ভোট ছাড়া এবং বাকিগুলিতে ৫ থেকে ১০% ভোটারের অংশগ্রহনে নির্বাচিত সরকারের কাছ থেকে কি অঙ্গীকার ও দায়বদ্ধতা আশা করা যায়?
বিএনপির পূণর্গঠনে খালেদা জিয়ার নির্দেশনা শুরুতে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের চাঙ্গা করে তুললেও এখন তা সামাল দিতে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতৃবৃন্দ পিছু হটছেন। প্রায় সব জেলা-উপজেলায় কোন্দল আয়ত্তের বাইরে চলে যাওয়ায় কমিটি গঠনে আটকে গেছে। জেলা ও মহানগরের কাউন্সিলরদের ভোটে কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি গঠনের বিষয়টি গঠনতন্ত্রে থাকলেও এর চর্চা কখনই বিএনপিতে দেখা যায়নি। গত দুটি জাতীয় কাউন্সিলে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার হাতে কাউন্সিলররা পূর্ণ ক্ষমতা ন্যস্ত করলে তাঁর নির্দেশেই সকল কমিটি গঠিত হয়। ধরে নেয়া যায়, এবারেও এর রকমফের হবে না। যদি জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয় তাহলে পূনর্গঠনের নামে তারেক রহমানের ইচ্ছেই সম্ভবত: বাস্তবায়িত হবে।
বছরের গোড়াতে ৫ জানুয়ারি কেন্দ্রিক আন্দোলন ব্যর্থতা ও নাশকতার চোরাগলিতে হারিয়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপির কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে। এখনও দলের বড় অংশ আত্মগোপনে ও জেলখানায়। মামলা তুলে নেয়ার আশ্বাসে নাশকতায় অভিযুক্ত বেশকিছু নেতা-কর্মী ইতিমধ্যে ক্ষমতাসীন দলে যোগ দিয়েছেন। এ অবস্থায় দলের অভ্যন্তরে পারস্পরিক অবিশ্বাস-সন্দেহের দোলাচল বাড়ছে। শুরু হয়েছে ব্লেম গেম। সরকার বিরোধী আন্দোলনে কার অবদান আছে, কারা সরকারের সাথে আঁতাত করছে-এ নিয়ে বিতর্ক ও বিষোদগার চলছে।
অবস্থা সামাল দিতে প্রায় একক দায়িত্বে খালেদা জিয়া দল পূনর্গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। জানুয়ারি-এপ্রিলের ব্যর্থতার পর বিএনপির মধ্যে প্রশ্ন উঠছিল আর কতকাল আন্দোলনের নামে ব্যর্থতার ঘানি টানতে হবে। ওই আন্দোলনের সিদ্ধান্ত এককভাবে নিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। ফলে দায়ভারও বর্তেছে তাঁর ওপর। ক্রসফায়ারে নিহত কর্মী, শীর্ষ নেতাদের কারাবরণ, শত শত মামলা, কমপক্ষে দেড়শ নিরীহ মানুষের লাশ, রিক্ত হাতে গুলশান কার্যালয় থেকে বাড়ি ফেরা- বিএনপি নেত্রীর হাতে দল পূনর্গঠন ছাড়া অন্য কোন অপশন কি আছে? বিশাল কর্মী বাহিনী ও জনসমর্থনপুষ্টতা সত্ত্বেও বেহাল এই দলটির ভবিষ্যত নির্ভর করছে খালেদা ও তারেকের সিদ্ধান্তের ওপর।
গণতান্ত্রিক কাঠামোবিহীন একটি দলে পূনর্গঠন বা পূনর্বিন্যাস ব্যক্তির ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে। ক্ষমতার মধ্যে জন্ম নেয়া বিএনপির রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রকৃত বিকাশ ঘটেছিল এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে। পূনর্বার ক্ষমতায় যেয়ে মধ্যপন্থার এই দলটি প্রবল ডানপন্থী ঝোঁক সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে দেশের রাজনীতিকে। গত ছয় বছরে বিএনপির বিবৃতিসর্বস্ব বা রাজপথে আন্দোলনের ফোকাস যদি হয়ে থাকে নির্দলীয়-নিরপেক্ষ নির্বাচন, তাহলে সেটি অর্জনের ব্যর্থতা দলটিকে ঠেলে দিয়েছে অতল খাদের কিনারে।
দলটির এই হৃতসর্বস্ব অবস্থা ক্ষমতাসীনদের করে তুলেছে আনপ্যারালাল। রাজপথ বা সংসদ- কোথাওই তাদের কোন বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে না। দল পূনর্গঠনের মাধ্যমে বিএনপি কতটা ঘুরে দাঁড়াতে পারবে- বলার সময় আসেনি। তবে একটি লক্ষ্যভেদী কৌশল, রাজনৈতিক কর্মসূচি ও অঙ্গীকার নিয়ে ময়দানে আসতে পূনর্বার ব্যর্থ হলে ইতিহাস হয়ে যেতে হবে। খালেদা জিয়া ও তদীয় পুত্র তারেক জিয়া কি দেয়ালের এই লিখন পড়তে সক্ষম?
আমাদের বুধবার
এই লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজের। এখানে প্রতিক্ষণ ডট কমের কোন নিজস্ব বক্তব্য নেই
প্রতিক্ষণ/এডি/এনজে